তৎপুরুষ সমাস

তৎপুরুষ সমাস: পূর্বপদে কতকগুলো বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস হয় তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। সাধারণত কে, রে বিভক্তি লোপ পায় এবং পরপদের অর্থের প্রাধান্য পায়।

দুটি অন্বিত বা সম্পর্কিত পদ থাকে। সাধারণত দুটি পদই বিশেষ্য হয়। প্রথমটি দ্বিতীয়টির অর্থকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। তৎপুরুষ শব্দের অর্থ তার সম্পর্কীয় পুরুষ।

তৎপুরুষের শ্রেণীবিভাগ: সাধারণত পূর্বপদের যে বিভক্তি লোপ পায় সেই বিভক্তির নামানুসারে তৎপুরুষের নামকরণ করা হয়। সেই হিসেবে তৎপুরুষ সমাসকে সাত ভাগে ভাগ করা হয়।

প্রথমা তৎপুরুষ বা কর্তৃবাচক তৎপুুষ: সাধারণত এই শ্রেণীতে কম সমাস সংগঠিত হয়। প্রথমা বিভক্তি লোপ পেয়ে এই সমাস হয়। যষ্ঠী তৎপুরুষ হিসেবেও একে বিবেচনা করা চলে। যেমন- দাগ-লাগা, হাতী কাঁদা (যে রাস্তায় চলতে হাতি কাঁদে), বাজপড়া (বাজড়ায় তিনজন লোক মারা গেছে)।

দ্বিতীয়া তৎপুরুষ বা কর্মবাচক তৎপুরুষ: পূর্বপদের দ্বিতীয়া বিভক্তি লোপ পেয়ে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন: বিস্ময়কে আপন্ন- বিস্ময়াপন্ন; চিরকাল ব্যাপিয়া সুখী- চিরসুখী; ভয়কে প্রাপ্ত- ভয়প্রাপ্ত; মাকে হারা- মাহারা; লক্ষ্মীকে ছাড়া-লক্ষ্মীছাড়া; ছেলেকে ধরা- ছেলেধরা; মানুষকে খেকো- মানুষখেকো; ঘরকে ধোয়া- ঘরধোয়া; জলকে তোলা- জলতোলা; গাকে টেপা- গাটেপা; মাথাকে গোঁজা- মাথাগোঁজা। এরকম: নথনাড়া, উঠানচষা, কাঠকাটা, রথদেখা, কলাবেচা, বৃত্তিপ্রাপ্ত, সাহায্যপ্রাপ্ত, জাতিগত, ফুলতোলা, মজ্জাগত, বিপদাপন্ন, দর্পচূর্ণ, নারী-নির্যাতন, আত্মহত্যা, চিরকুমার (ব্যাপিয়া অর্থে), চিরসুখী, চিরবসন্ত ইত্যাদি।

তৃতীয়া তৎপুরুষ বা করণবাচক তৎপুরুষ: পূর্বপদে তৃতীয়া বিভক্তি লোপ পেয়ে যে তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে তৃতীয়া তৎপুরুষ বলে। এ সমাসে পরপদের সঙ্গে পূর্বপদের করণ-সম্পর্ক হয়, যে কারণে একে করণবাচক তৎপুরুষ সমাসও বলে। যেমন: ঈশ্বর দ্বারা দত্ত- ঈশ্বরদত্ত; কষ্ট দ্বারা সাধ্য- কষ্টসাধ্য; পদ দ্বারা দলিত- পদদলিত; মন দিয়ে গড়া- মনগড়া; মধু দিয়ে মাখা- মধুমাখা; ঢেঁকি দ্বারা ছাঁটা- ঢেঁকিছাঁটা; বাপ দ্বারা খেদানো- বাপখানো; আইন দ্বারা সংগত- আইনসংগত; বায়ু দ্বারা চালিত- বায়ুচালিত; শ্রম দ্বারা লব্ধ- শ্রমলব্ধ, রাহু দ্বারা গ্রস্ত- রাহুগ্রস্ত; শ্রী দ্বারা যুক্ত- শ্রীযুক্ত; ছায়া দ্বারা শীতল- ছায়াশীতল।

এরকম: হাতগড়া, পাতাছাওয়া, ঝাঁটাপেটা, পোয়াকম, নুনমাখা, সর্পদষ্ট, কীটদষ্ট, বাতাহত, সখ্যলখ্য, বাগ্দত্তা, বিনয়াবনত, বিস্ময়বিহবল, ইচ্ছালব্ধ, মৎকৃত, ক্ষমাহীন, বায়ুপূর্ণ, কণ্টকাকীর্ণ, জনশূন্য, বিবেকরহিত, মাতৃহীন ও রোগপীড়িত।

চতুর্থী তৎপুরুষ বা উদ্দেশ্যবাচক তৎপুরুষ: এ সমাসে পূর্বপদে চতুর্থ বিভক্তি (কে, রে) কিংবা নিমিত্তবাচক অনুসর্গ (নিমিত্ত, জন্য, উদ্দেশ্য) লোপ পায়। চতুর্থ বিভক্তি লোপ পায় বলেই একে চতুর্থী তৎপুরুষ বলে। যেমন- রণের জন্য সজ্জিত-রণসজ্জিত।
সর্বের জন্য হিত- সর্বহিত
মড়ার জন্য কান্না- মড়াকান্না
জীয়নের (জন্ম) জন্য কাঠি- জীয়নকাঠি
বিয়ের নিমিত্ত পাগলা- বিয়েপাগলা
ডাকের জন্য মাশুল- ডাকমাশুল
ধানের জন্য জমি- ধানজমি
দেবের জন্য দত্ত- দেবোত্তর
পীরের জন্য দত্ত- পীরোত্তর
মালের জন্য গুদাম- মালগুদাম
বালিকাদের নিমিত্ত বিদ্যালয়- বালিকাবিদ্যালয়
পাগলদের নিমিত্ত গারদ- পাগলাগারদ

এরকম: অতিথীশালা, ঔষধালয়, পান্থশালা, শিশুসাহিত্য, পাঠশালা, রান্নাঘর, হজযাত্রা, পাঠশালা, পাঠকক্ষ, বৈঠকখানা ও ভোজনালয়।

পঞ্চমী তৎপুরুষ বা অপাদানবাচক তৎপুরুষ: পূর্বেপদে পঞ্চমী বিভক্তি (হতে, থেকে, চেয়ে) লোপ পেয়ে যে তৎপুরুষ সমান হয় তাকে পঞ্চমী তৎপুরুষ বলে। পূর্বপদের সাথে পরপদের অপাদান সম্পর্ক তৈরি হয়, সে কারণে একে অপাদানবাচক তৎপুরুষও বলা যেতে পারে। যেমন-
স্বর্গ হতে চ্যুত-স্বর্গচ্যুত অগ্নি হতে ভয়-অগ্নিভয়
ব্যাঘ্র হতে ভীত-ব্যাঘ্রভীত চৌর হতে ভয়-চৌরভয়
সর্ব হতে শ্রেষ্ঠ-সর্বশ্রেষ্ঠ স্বর্গ হতে ভ্রষ্ট-স্বর্গভ্রষ্ট
ঘর হতে ছাড়া-ঘরছাড়া দুগ্ধ হতে জাত-দুগ্ধজাত
গাঁ হতে ছাড়া-গাঁছাড়া আদি থেকে অন্ত-আদ্যন্ত
ঘর হতে পালানো-ঘরপালানো আকাশ থেকে বাণী-আকাশবাণী
আগা হতে গোড়া-আগাগোড়া জেল থেকে খালাস-জেলখালাস
থলে হতে ঝাড়া-থলেঝাড়া তদ্ থেকে ভব-তদ্ভব

আরো উদাহরণ: পালছাড়া, পাপমুক্ত, বিদেশাগত, বিপদুত্তীর্ণ, ভুক্তাবশেষ, তদ্ভিন্ন, গৃহনির্গত, লক্ষ্যচ্যুত, লক্ষ্যভ্রষ্ট, শাপভ্রষ্ট, পদস্খলন, রোগমুক্ত।

যষ্ঠী তৎপুরুষ বা সম্বন্ধবাচক তৎপুরুষ: সম্বন্ধ দ্যোতক সম্পর্কে (অন্বয়ে) এবং পূর্বপদের ষষ্ঠী বিভক্তির লোপ পেয়ে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন-
বামনের পাড়া-বামনপাড়া মাতার তুল্য-মাতৃতুল্য
নদীর জল-নদীজল ফুলের গাছ-ফুলগাছ
বন্ধুর গণ-বন্ধুগণ বটের তলা-বটতলা
ঠাকুরের বাড়ি-ঠাকুরবাড়ি ধানের ক্ষেত-ধানক্ষেত
ভাইয়ের পো-ভাইপো হাঁসের রাজা-রাজহাঁস
ধানের ক্ষেত-ধানক্ষেত পথের রাজা-রাজপথ
রান্নার ঘর-রান্নাঘর হাতের ঘড়ি-হাতঘড়ি
বেগুনের বাড়ি-বেগুনবাড়ি তালের গাছ-তালগাছ
তালের পাতা-তালপাতা ঠাকুরের পো-ঠাকুরপো
বিল্বের পত্র-বিল্বপত্র ঠাকুরের ঝি-ঠাকুরঝি
পুকুরের ঘাট-পুকুরঘাট চায়ের বাগান-চাবাগান

আরো উদাহরণ: মৌচাক, জাহাজঘাটা, ফুলবাগান, রাজাবাজার, সাহেববাগান, সাহেববাজার, হিন্দুস্থান, রেলকুলি, খ্রীস্টধর্ম, দিল্লীশর¦, ছাত্রসমাজ, গ্রন্থাগার, জীবনচরিত, নদীতীর, কর্মকর্তা, চন্দ্রগ্রহণ, জ্ঞানতাপস, জাহাজডুবি ইত্যাদি।

লক্ষণীয়: ‘সমূহ’ বাচক পদের যোগ যেখানে থাকে, সেখানে ষষ্ঠী তৎপুরুষ হয়। যেমন- বিদ্বজ্জন, ধেনুকুল, পন্ডিতগণ, রতœরাজি ইত্যাদি।

সপ্তমী তৎপুরুষ বা স্থান-কালবাচক তৎপুরুষ: পূর্বপদে সপ্তমী বিভক্তির (এ, ত, য়) লোপ পেয়ে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়। এই সমাসে পরপদের সঙ্গে পূর্বপদের অধিকরণ সম্পর্ক তৈরি হয়। যেমন-
গাছে পাকা-গাছপাকা গৃহে বন্দী-গৃহবন্দী
ঘরেতে বাস-ঘরবাস মনে লাগা-মনলাগা
মাথাতে ব্যথা-মাথাব্যথা গৃহে প্রবেশ-গৃহপ্রবেশ
অকালে পক্ব-অকালপক্ব সংখ্যায় গরিষ্ঠ-সংখ্যাগরিষ্ঠ
গোলায় ভরা-গোলাভরা রাতে কানা-রাতকানা
বাটায় ভরা পান-বাটা-ভরা পান শিল্পতে পটু-শিল্পপুট
জলে মগ্ন-জলমগ্ন অরণ্যে বাস-অরণ্যবাস
পূর্বে শ্রুত-শ্রুতপূর্ব বিশ্বে বিখ্যাত-বিশ্ববিখ্যাত
পূর্বে দৃষ্ট-দৃষ্টপূর্ব

এরকম: ঘরপোড়া, গুণমুগ্ধ, চরণাশ্রিত, তালকানা, নরাধম, আকাশগঙ্গা, কাশীবাসী, নামমাত্র, দক্ষিণাপথ, শয্যাশায়ী, লোকবিশ্রুত, বাক্সবন্দী, ইংরেজি-শিক্ষিত, পকেটজাত, লিস্টিভুক্ত ইত্যাদি।

উপপদ তৎপুরুষ: উপসর্গ ভিন্ন শব্দকে উপপদ বলে। এভাবে উপপদের সাথে কৃদন্ত পদের (কৃৎ প্রত্যয়ান্ত পদ) যে সমাস হয় তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে। এক্ষেত্রে প্রথমে উপপদ এবং পরে কৃদন্ত পদ বসে। বিভক্তি যুক্ত ক্রিয়াপদকে এক্ষেত্রে সাধারণত কৃদন্ত পদ বলা হয়। যেমন-
যেতন ভোগ করে যে-বেতনভোগী।
ভেক ধরে যে-ভেকধারী।
ইঁদুর মারা যায় এমন বিষয়-ইঁদুরমারা।
মাছি মারা যায় এমন বিষয়-মাছিমারা।
মধু করে যে-মধুকর।
আকাশে চারণ করে যে-আকাশচারী।

অনুরূপ: জলচর, ঘরছাড়া, শাস্ত্রজ্ঞ, বাজিকর, চিত্রকর, নিশাচর, জাদুকর, পণ্যজীবী, বুদ্ধিজীবী, (বুদ্ধি জীবে যে), শ্রমজীবী, নাট্যকার, মণিহারা, গৃহহারা, পঙ্কজ, মধুপ, ইন্দ্রজিৎ, ধনঞ্জয় ইত্যাদি।

নঞ তৎপুরুষ: বাংলায় না, নাই, অথবা নয় এর অর্থে সংস্কৃতে ‘নঞ’ প্রত্যয় আছে। না-বাচক পূর্বপদের সাথে বিশেষ্য বা বিশেষণ রূপে পরপদের যে সমাস হয় তাকে নঞ তৎপুরুষ সমাস বলে। পূর্বপদে অ, অন, অনা, আ, গর, ন, না, বি, বে এসব বসে না অর্থ প্রকাশ করে। যেমন-
নয় কথ্য-অকথ্য নয় অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ
নয় গোছালা-অগোছালা নয় উর্বর-অনুর্বর
নেই নাথ-অনাথ নয় আকাক্সিক্ষত-অনাকাক্সিক্ষত
নয় পবিত্র-অপবিত্র নয় দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘ
নয় মানুষ-অমানুষ নয় খোশ-নাখোশ
নেই সুখ বা সুখের অভাব-অসুখ নেই খুঁত-নিখুঁত
নয় চেনা-অচেনা শৃঙ্খলার অভাব-বিশৃঙ্খলা

আরো উদাহরণ: অধর্ম, আসাধু, অধীর, অস্থির, অনেক, অনভ্যাস, অজানা, অকাজ, আগাছা, আধোয়া, আলুনি, অফুরন্ত, অমিল, অনামুখ ইত্যাদি।

অলুক তৎপুরুষ: তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের বিভক্তি লোপ না হলে তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। প্রায় সবগুলো তৎপুরুষ সমাসে অলুক হয়ে থাকে। যেমন-
পায়ে পড়ে যে- পায়েপড়া হাত দ্বারা গড়া-হাতেগড়া
গরু দ্বারা চালিত গাড়ি-গরুরগাড়ি গুরুর জন্য গোয়াল-গরুরগোয়াল
খেলার জন্য মাঠ-খেলারমাঠ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান-গায়েহলুদ

অনুরূপ: মামার বাড়ি, বানে ভাসা, ছিপে গাঁথা, মনসিজ, গায়ের চাদর, সাপে কাটা, তিলের তেল, গোড়ায় গলদ, বালির বাঁধ ইত্যাদি।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page