জীবে প্রেম করে যেই জন / সেই জন সেবিছে ঈশ্বর

জীবে প্রেম করে যেই জন / সেই জন সেবিছে ঈশ্বর

মূলভাব : জীবের আত্মারূপে খোদা জীবের ভিতরে অবস্থান করেন। এইজন্য জীবের পরিসেবা করলেই স্রষ্টার পরিসেবা করা হয়। বস্তুত জীবের প্রতি বিশুদ্ধ না হয়ে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা যায় না। সৃষ্টিকে ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবলমাত্র স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা যায়।

সম্প্রসারিত ভাব : মহাবিশ্বে যা কয়েকটি রয়েছে সবই স্রষ্টার সৃষ্টি। সমস্ত জীবজগৎ তিনিই তৈরি করেছেন অধিক উৎকর্ষ যত্নে, উদাহরণসরূপ অতি ভালোবাসায় তৈরি করেছেন মানুষ। তাঁর মহাশক্তির ক্ষুদ্রাংশ শক্তি জীবজগতের প্রত্যেকের ভিতরে বিরাজমান। অর্থাৎ জীবজগতের সবকিছুর মধ্যেই তাঁর শক্তির উপস্থিতি রয়েছে। কাজেই জীবের প্রতি দয়া পদর্শন করা আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য। কেননা জীবসেবা করলেই প্রকারান্তরে স্রষ্টার পরিসেবা করা হয়। জীবের প্রতি যত্নবান হলে বা জীবকে ভালোবাসলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা শো করা হয়। এ জন্যেই স্বমী বিবেকানন্দ বলেছেন-
জীবে প্রেম করে যেই
জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”

সংসারের সবকিছুর স্পর্শে থেকেই ঈশ্বর সম্বন্ধীয় ভজন করা যায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে ধ্যানমগ্ন হলেই সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করা যায় না। আবার নির্জনে ভজন করলেই ঈশ্বর লাভে পূর্ণতা আসে না। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে প্রস্তুত করেছেন মানবীয় গুণাবলি দিয়ে, জ্ঞান ও বিবেকবুদ্ধি প্ল্যান দিয়ে। যে কারণে জীবজগতের ভিতরে সেরা। কোজেই সর্বসেরা হিসেবে মানুষের প্রতি উদাহরণসরূপ মানুষের দায়িত্ব ও উচিত রয়েছে, তেমনি প্রত্যেকটি জীবের প্রতিও রয়েছে সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য। জীবে সেবা না করে শুধু সেবায় মগ্ন হলে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না। জীব জগৎ নিধনে অভিরুচি হলে একসময় মনুষ্যজীবনও বিপন্ন হয়ে পড়ে। 

এজন্য বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে “জীবহত্যা মহাপাপ”। কথাটা আধুনিক বিশ্বে অধিকতর প্রণিধানযোগ্য। উদ্ভিদ ও জীবজগৎ বিনাশ করার ফলে পার্থিব পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আর তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে মানুষকেই। অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা অধিক প্রভাব পড়ছে মানুষের উপর। জীবন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তার মনবতাবোধের সক্রিয়তায় অসাম্য, বিভেদ, লোভ, ঈর্ষা মুছে করার পরিবর্তে নিজেই হয়ে উঠছে লোভী, স্বার্থপর, হিংস্র। এজন্য জীবকে অবজ্ঞা ও হেলা করলে, জীবের প্রতি অমানবিক হলে ঈশ্বরকেই অবজ্ঞা করা হয়- এই বোধ আমাদেরকে লালন ও পালন করতে হবে। আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে জীবসেবায়, জীবকে ভালোবাসায়।

মন্তব্য : স্রষ্টার তৈরি অর্থাৎ জীবজগৎকে প্রেমের দৃষ্টিতে দেখলে, তাদের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করলে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য নিশ্চিত হয়। ঈশ্বর সম্বন্ধীয় প্রস্তুত জীবের প্রতি মমতার সাহায্যে মহিমা অনুভব করা সম্ভব। এজন্য জীবজগতের বিনাশের পরিবর্তে তাদের প্রতি উত্তম যত্নবান হওয়া পরম প্রয়োজন।

এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও কালেক্ট করে দেয়া হলো

স্রষ্টার জন্মের ভিতরে মনুষই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। নানারকম সমাজের মানুষ বিভিন্নভাবে স্রষ্টার স্তুতি করিয়া থাকে। আরাধনার প্রক্রিয়ায় মহাব্যবধান লক্ষ্য যায়। কিন্তু ইহার ফোকাস এক ও একতা তার সাথে তাহা হইতেছে সৃষ্টিকর্তার সন্তষ্টি বিধান। জগতে বিভিন্ন যুগে নানারকম মনিষীর উদ্ভব হইয়াছে। বিভিন্ন ধর্মের অবতারণা হইয়াছে তার সাথে আরাধনার বিভিন্ন চেহারা ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হইয়াছে। স্রষ্টাকে পাওয়ার বা স্রষ্টার সন্তুষ্টি বিধানই সবার শুধুমাত্র উদ্দেশ্য। এতদৃসত্ত্বেও সাধারণ মানুষের পক্ষে স্রষ্টার প্রকৃত অস্তিত্ব উদ্ভাবন সম্ভব হয়। কারণ নিরাকার, অক্ষয়, অব্যয় স্রষ্টা চিরদিন আমাদের সংস্পর্শের বাহিরে, এজন্য আমরা নানাভাবে নানা জায়গায় তাহার সন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াই সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়া।

পৃথিবীর মধ্যযুগের সকল বিদ্বান ও ধর্মগুরু এই বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেন যেই, স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের জন্য দেশ দেশান্তরে যাওয়ার দরকার নাই। স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রতিটি সৃষ্ট জীবের মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে। সুতরাং আবির্ভাবের সেবায় যিনি নিজকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করিতে পারেন, তিনিই স্রষ্টার নৈকট্য লাভে উপযুক্ত হন। যে লোক প্রতিনিয়ত আর্তক্লিষ্ট ও নিপীড়িত মানবতার সেবায় নিজেকে বিলাইয়া দিতে উপযুক্ত হইয়াছেন, তিনিই প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ উপাসক ও সাধক। সেই কারণে বলা হইয়া থাকে-
He prayeth best who loveth best,
All things both great and small.

আরো পড়ুনঃ

Leave a Comment

You cannot copy content of this page