কোষ চক্র ও ইন্টারফেজ (Cell Cycle & Interphase)

কোষ চক্র ও ইন্টারফেজ (Cell Cycle & Interphase)
কোষ চক্র ও ইন্টারফেজ (Cell Cycle & Interphase)

কোষ চক্র ও ইন্টারফেজ (Cell Cycle & Interphase) 

একটি সুস্থ বর্ধিষ্ণু কোষের জীবন শুরু হয় তার মাতৃকোষের বিভাজনের মাধ্যমে এবং শেষ হয় নিজে বিভাজিত হয়ে অপত্য কোষ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। একটি কোষ সৃষ্টি, এর বৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে বিভাজন—এ তিনটি কাজ যে চক্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় তাকে বলা হয় কোষ চক্র (Cell Cycle)।

আরো পড়ুনঃ

হাওয়ার্ড ও পেল্ক (Howard & Pelc, 1953) এই কোষ চক্রের প্রস্তাব করেন। এই চক্রটি বার বার চলতেই থাকে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির দেহে ১০০ (১০১৪) ট্রিলিয়ন (trillion) কোষ থাকে। দেহকে সুস্থ রাখতে হলে এর মধ্যে সঠিক সময়ে সঠিক কোষটিকে বিভক্ত হতে হবে। এ বিভাজনের জন্য প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রয়োজনীয় সিগনাল বা সংকেত।

কিছু কোষ আছে যারা দ্রুত বিভাজনের জন্য বিশেষায়িত (যেমন ভ্রূণ কোষ, মূল ও কাণ্ডের শীর্ষ মেরিস্টেম কোষ); কিছু কোষ আছে প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা পেলে বিভাজিত হতে পারে; আবার অনেক কোষ আছে কখনো বিভক্ত হয় না, যেমন আমাদের পূর্ণাঙ্গ লাল রক্ত কোষ, পেশিকোষ, স্নায়ুকোষ, উদ্ভিদের স্থায়ী কোষসমূহ। 

কোষ চক্র দুটি প্রধান ধাপে বিভক্ত, যথাকোষের বিভাজনরত অবস্থাকে বলা হয় এম. ফেজ (Mitotic Phase) বা মাইটোসিস এবং দুটি এম. ফেজ-এর মধ্যবর্তী অবিভাজন অবস্থাকে বলা হয় ইন্টারফেজ (Interphase)। অন্যভাবে, একটি কোষ পরপর দু’বার বিভক্ত হওয়ার মধ্যবর্তী সময় বা পর্যায়ই হলো ইন্টারফেজ।

এম. ফেজ এবং ইন্টারফেজ পর্যায়ক্রমিকভাবে পরপর এসে কোষ চক্র সম্পন্ন করে। কোষ চক্রের মোট সময়ের মাত্র ৫-১০ ভাগ ব্যয় হয় এম. ফেজ-এ, আর বাকি ৯০-৯৫ ভাগ সময় ব্যয় হয় ইন্টারফেজ অবস্থায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মাত্র অল্পসংখ্যক কোষ মাইটোসিস পর্যায়ে থাকে এবং অধিকাংশ সময় অধিকাংশ কোষই ইন্টারফেজ পর্যায়ে থাকে।

একটি জেনেটিক প্রোগ্রাম দ্বারা কোষ চক্র নিয়ন্ত্রিত হয়। অভ্যন্তরীণ উদ্দীপনা প্রদান করে সাইক্লিন-Cdk যৌগ। বিভিন্ন হরমোন ও গ্রোথ ফ্যাক্টর (gf) বাহ্যিক উদ্দীপনা দান করে। 

চিত্র ২.২ : হাওয়ার্ড ও পেক্ষ কোষ চক্র। 

আমাদের দেহের কোনো স্থান কেটে গেলে রক্তের অণুচক্রিকা একটি গ্রোথ ফ্যাক্টর তৈরি করে যার উদ্দীপনায় চারপাশের কোষ বিভাজিত হয়ে ক্ষতস্থান জোড়া লাগিয়ে দেয়। দেহের ইমিউন সিস্টেমের জন্য দরকারি কোষসমূহ বিভাজিত হওয়ার জন্য শ্বেত রক্তকণিকা একটি গ্রোথ ফ্যাক্টর তৈরি করে দেয়। Bone marrow-তে লোহিত রক্তকণিকা কোষের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ‘কিডনি’ erythroprotein তৈরি করে। 

ইন্টারফেজ (Interphase) :

(ক) ইন্টারফেজ (Interphase) : ইন্টারফেজ অবস্থাটি বেশ দীর্ঘ। পরবর্তী বিভাজন পর্যায়টিকে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য ইন্টারফেজ অবস্থায় নিউক্লিয়াসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে থাকে। তাই ইন্টারফেজ অবস্থায় কোষের নিউক্লিয়াসকে বলা হয় বিপাকীয় নিউক্লিয়াস। এক কথায় বলা যায় M. Phase (মাইটোটিক ফেজ)-কে সুসম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় ইন্টারফেজ অবস্থায়।

কোষচক্রের মোট সময়ের ৯০-৯৫ ভাগ সময় ব্যয় হয় ইন্টারফেজ অবস্থায়। ইন্টারফেজ-কে সাধারণত ৩টি উপ-পর্যায়ে ভাগ করা হয়; যথা- G1, S এবং G2 দশা। টার্গেট কোষের (যে কোষ বিভাজিত হবে) সার্ফেসে বিশেষ রিসেপ্টর প্রোটিনের সাথে গ্রোথ ফ্যাক্টর সংযুক্ত হয়ে কোষ চক্র শুরু করার নির্দেশ দান করে। 

i. G1 দশা (Gap phase) : একটি কোষ পরবর্তীতে বিভাজন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে কিনা, তার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় G1 উপপর্যায়ে। G1-এর প্রথমেই সাইক্লিন নামক এক প্রকার প্রোটিন তৈরি হয় যা Cdk (Cyclin dependent kinase) এর সাথে যুক্ত হয়ে সমগ্র প্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। Cdk ফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এ সময় প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রোটিন, RNA এবং DNA রেপ্লিকেশনের সকল উপাদান তৈরি হয়। যে কোষটি আর বিভাজিত হবে না। তা এক সপ্তাহ বা এক বছর অর্থাৎ আমৃত্যু G1 উপপর্যায়েই আবদ্ধ হয়ে যায়। মোট কোষ চক্রের ৩০-৪০% সময় এই উপপর্যায়ে ব্যয় হয়। 

ii. Sদশা (S = Synthesis) : এই উপপর্যায়ের প্রধান কাজ হলো নিউক্লিয়াসে ক্রোমোসোমস্থ DNA সূত্রের রেপ্লিকেশন। পরবর্তী উপ-পর্যায়ে প্রবেশের আগেই DNA রেপ্লিকেশন সম্পন্ন হয়। এই উপপর্যায়ে সময় ব্যয় হয় মোট সময়ের ৩০-৫০ ভাগ। DNA সংশ্লেষণ ঘটে ১ দশায়। 

iii. G2 দশা (Gap2 phase) : এটি হলো M. Phase-এ (মাইটোসিস দশা) প্রবেশ করার প্রস্তুতি পর্যায়। এই উপপর্যায়ের প্রধান কাজ হলো মাইক্রোটিউবিউল গঠনকারী পদার্থ সংশ্লেষণ যা দিয়ে মাইটোসিস পর্যায়ে স্পিন্ডল তন্ত্র তৈরি হবে। একটি সেন্ট্রোসোম থেকে দুটি সেন্ট্রোসোম-এ পরিণত হয়।

সেন্ট্রোসোম মাইক্রোটিউবিউল তৈরি সূচনা করে। বিভাজন প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি (ATP) তৈরি হয়। G2 থেকে মাইটোসিস-এ প্রবেশ করতে হলে ম্যাচুরেশন প্রোমোটিং ফ্যাক্টর (MPF) নামক প্রোটিনের প্রয়োজন পড়ে। কিছু সংখ্যক কোষ G2 উপপর্যায়ে এসেও আটকা পড়ে যায়, আর কখনো বিভাজন পর্যায়ে প্রবেশ করে না। মোট সময়ের ১০-২০ ভাগ সময় এ উপপর্যায়ে ব্যয় হয়। 

কোষ চক্র ও ইন্টারফেজ (Cell Cycle & Interphase)

কোষচক্রের নিয়ন্ত্রক 

কোষচক্রের নিয়ন্ত্রক হলো সাইক্লিন প্রোটিন এবং Cdk। মানুষের কোষে চার প্রকার সাইক্লিন থাকে।

সাইক্লিন-D : কোষকে G থেকে S এবং S পর্যায় থেকে G2 পর্যায়ে নিয়ে যায়।

সাইক্লিন-E : S-পর্যায়ে DNA রেপ্লিকেশনের জন্য কোষকে প্রস্তুত করে।

সাইক্লিন-A : S-পর্যায়ে DNA রেপ্লিকেশন সক্রিয় ও ত্বরান্বিত করে।

সাইক্লিন-B : মাইটোটিক স্পিন্ডল তৈরিসহ মাইটোসিসের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সম্পন্ন করে। 

Sea Urchin-এর ডিমের প্রোটিন সংশ্লেষণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে Tim Hunt দৈবক্রমে বা অপ্রত্যাশিতভাবে সাইক্লিন প্রোটিন (তিনিই এই নাম দেন) আবিষ্কার করেন। এজন্য তিনি ২০০১ সালে নোবেল প্রাইজ পান। 

জীব জীবনে ইন্টারফেজ-এর গুরুত্ব : জীব জীবনে কোষের ইন্টারফেজ পর্যায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ। 

(i) কোষটি পরবর্তী কোষ বিভাজনে অংশগ্রহণ করবে কিনা তা ইন্টারফেজ-এর প্রথম দিকেই ঠিক হয়। 

(ii) পরবর্তী কোষ বিভাজনের জন্য প্রোটিন, RNA ও DNA রেপ্লিকেশনের সকল উপাদান তৈরি হয়। (iii) DNA রেপ্লিকেটেড হয়। 

(iv) কোষ বিভাজনের প্রয়োজনীয় স্পিন্ডল তন্ত্র তৈরির জন্য মাইক্রোটিউবিউলস সৃষ্টি হয়। 

(v) কোষ বিভাজনের প্রয়োজনীয় শক্তি (ATP) তৈরি হয়। 

(vi) ইন্টারফেজ পর্যায় না থাকলে বিভাজন পর্যায় সম্পন্ন হবে না। বিভাজন প্রক্রিয়া না থাকলে কোষের সংখ্যাবৃদ্ধি, জীবের পূর্ণাঙ্গ গঠন ও বিকাশ হবে না, অর্থাৎ নতুন জীবই সৃষ্টি হবে না। 

জীব জীবনে কোষ চক্রের গুরুত্ব/তাৎপর্য : ইন্টারফেজ ও মাইটোটিক কোষ বিভাজন পর্যায়ক্রমিকভাবে এসে কোষ চক্র সম্পন্ন করে। কোষচক্রের গুরুত্ব অসীম 1 

(i) কোষ চক্র না হলে এককোষী বা বহুকোষী কোনো জীবেরই বংশবৃদ্ধি হবে না। 

(ii) কোষ চক্রের ইন্টারফেজ-এর প্রস্তুতির কারণেই মাইটোসিস হয়, আর মাইটোসিস বহুকোষী জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটায়, প্রজননঅঙ্গ তৈরি করে এবং ক্ষয়পূরণ করে। 

(iii) প্রতিটি জীবে স্বাভাবিক কোষ চক্র ঐ জীবের স্বাভাবিক বৃদ্ধি সম্পন্ন করে। 

(iv) অস্বাভাবিক অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত কোষ চক্র জীবদেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত করে। এমনকি ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করে থাকে। 

(খ) M-Phase বা মাইটোটিক ফেজ :

(খ) M-Phase বা মাইটোটিক ফেজ : কোষ চক্র G2 ফেজ থেকে মাইটোসিস বা বিভাজন পর্যায়ে প্রবেশ করে। একটি জটিল প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের বিভাজন ও পুনঃগঠন, সাইটোপ্লাজমের নতুন দুই কোষে গমন, সেলমেমব্রেন এবং উদ্ভিদ কোষে কোষপ্রাচীর গঠনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ দুটি অপত্য কোষ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে M-Phase সমাপ্ত হয়। কোষ চক্রের মোট সময়ের মাত্র ৫-১০ ভাগ সময় ব্যয় হয় মাইটোটিক ফেজের জন্য। স্তন্যপায়ীদের কোষ চক্র মাইটোটিক দশা ১-১.৫ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এভাবেই ইন্টারফেজ M-ফেজইন্টারফেজ চক্রাকারে চলতে থাকে।

ইন্টারফেজ এবং M. phase এর মধ্যে পার্থক্য 

Inter-Phase M-phase 
১। এটি কোষ বিভাজনের প্রস্তুতি দশা।  ১। এটি কোষের প্রকৃত বিভাজন দশা। 
২। কোষচক্রের ৯০-৯৫% সময় এখানে ব্যয় হয়।  ২। কোষ চক্রের ৫-১০% সময় এখানে ব্যয় হয়। 
৩ । এ দশায় কোষীয় সংগঠনের বৃদ্ধি এবং সংখ্যাগত বৃদ্ধি ঘটে । ৩। এ দশায় কোষীয় সংগঠনের বিস্তার ও বিভাজন ঘটে
৪। এ দশায় বংশগতীয় বস্তু ক্রোমাটিন হিসেবে থাকে।  ৪। এ দশায় বংশগতীয় বস্তু ক্রোমোসোম হিসেবে থাকে।
কোষ চক্র ও ইন্টারফেজ (Cell Cycle & Interphase)




এই কোষ চক্র ও ইন্টারফেজ (Cell Cycle & Interphase) ছাড়াও আরো জানুন