উপন্যাসের সংজ্ঞা , গঠন ও প্রকারভেদের বিস্তারিত

উপন্যাসের সংজ্ঞা , গঠন ও প্রকারভেদের বিস্তারিতঃ উপন্যাস গণতন্ত্রের দান, গণমানুষের আত্মজাগরণের দান। উপন্যাস হলো বাস্তব জীবনের কল্পিত রূপ। ‘উপন্যাস’ শব্দটির বুৎপত্তি হচ্ছে: উপ-নি-আস+অ (ঘঞ্জ), যার অর্থ উপস্থাপন। এর আভিধানিক অর্থ ঘটনাবহুল আখ্যান, কল্পিত কাহিনি, অভিনব সৃষ্টি, অপূর্ব উপস্থাপন ইত্যাদি।

উপন্যাসের সংজ্ঞা , গঠন ও প্রকারভেদের বিস্তারিত
উপন্যাসের সংজ্ঞা , গঠন ও প্রকারভেদের বিস্তারিত
একটি সমাজের পটভূমিতে মানবজীবনের বাস্তব রূপকে কল্পিতভাবে প্রকাশ করা হলে, তখন তাকে উপন্যাস বলে। ঔপন্যাসিক শ্রীশচন্দ্র দাশের মতে- “গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত জীবন দর্শন ও জীবনানুভূতি কোনো বাস্তব কাহিনি অবলম্বন করিয়া যে বর্ণনাত্মক শিল্প কর্মে রূপায়িত হয়, তাহাকে উপন্যাস বলে।”
বস্তুত উপন্যাস জীবন নয়, জীবনের ছায়াপাত, খণ্ডিত জীবন নয়, অখণ্ড জীবনের ছায়াপাত, জীবনের কার্বন কপি নয়, ইঙ্গিতময়, অর্থপূর্ণ; খণ্ডিত জীবন নয়, অখণ্ড জীবনই উপন্যাসের কাম্য।

তাই উপন্যাস জীবনের নিকটতম শিল্প; ঘটনার ধারাবাহিক সামঞ্জস্যপূর্ণ বিন্যাস। আকর্ষণীয় গাল্পিক রস, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্র, চরিত্র অনুযায়ী সংলাপ, বাস্তবতার আলোকে বর্ণনা একটি সার্থক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য।


উপন্যাস আধুনিক যুগে সমাজ ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে ব্যক্তি মানুষের বেঁচে থাকার যে জীবন সংগ্রাম, তারই মহাকাব্যিক রূপ।


উপন্যাসের গঠন কৌশলের শর্তাবলি

একটি সার্থক উপন্যাসের জন্য কয়েকটি শর্ত বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর সেগুলো হচ্ছে-
১. প্লট বা আখ্যানভাগ
২. কাহিনি বা ঘটনা বিন্যাস
৩. চরিত্র চিত্রণ
৪. জীবন দর্শন বা সমাজচিত্র
৫. ভাষা ও বর্ণনা ভঙ্গি
৬. প্রণয় রস।
সাধারণত এসব বৈশিষ্ট্য একটি উপন্যাসের কাম্য। তবে সময়ের দাবি অনুযায়ী উপন্যাসও খোলস বদলাচ্ছে। তাই আজকাল বৈশিষ্ট্যের ওপর উপন্যাস নির্ভরশীল নয়।

উপন্যাসের সংজ্ঞা

সাহিত্যের রূপশ্রেণি : উপন্যাস

উপন্যাস আধুনক কালের একটি বিশিষ্ট শিল্পরূপ। উপন্যাসের আক্ষরিক অর্থ হলো উপযুক্ত বা বিশেষ রূপে স্থাপন। অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে কাহিনি-রূপ একটি উপাদানকে বিবৃত করার বিশেষ কৌশল, পদ্ধতি বা রীতি। অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে গদ্যে লিখিত এমন এক বিবরণ বা কাহিনি যার ভেতর দিয়ে মানব-মানবীর জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়ে থাকে।


এভাবে ব্যুৎপত্তিগত এবং আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, মানব-মানবীর জীবন যাপনের বাস্তবতা অবলম্বনে যে কল্পিত উপাখ্যান পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য বিশেষ বিন্যাসসহ গদ্যে লিপিবদ্ধ হয় তাই উপন্যাস। যেহেতু উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য মানুষের জীবন তাই উপন্যাসের কাহিনী হয় বিশ্লেষণাত্মক, দীর্ঘ ও সমগ্রতাসন্ধানী। বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক ঊ.গ. ঋড়ৎংঃবৎ-এর মতে, কমপক্ষে ৫০ হাজার শব্দ দিয়ে উপন্যাস রচিত হওয়া উচিত।
বিখ্যাত উপন্যাস বিশ্লেষকগণ একটি সার্থক উপন্যাসের বিভিন্ন উপাদানের কথা বলেছেন।

সেগুলো হচ্ছে
১. প্লট বা আখ্যান;
২. চরিত্র;
৩. সংলাপ;
৪. পরিবেশ বর্ণনা;
৫. লিখনশৈলী বা স্টাইল;
৬. লেখকের সামগ্রিক জীবন-দর্শন।


১. প্লট বা আখ্যান : উপন্যাসের ভিত্তি একটি দীর্ঘ কাহিনী। যেখানে মানব-মানবীর তথা ব্যক্তির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, ঘৃণা-ভালোবাসা ইত্যাদি ঘটনা প্রাধান্য লাভ করে। উপন্যাসের প্লট বা আখ্যান হয় সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত। প্লটের মধ্যে ঘটনা ও চরিত্রের ক্রিয়াকাণ্ডকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয় যাতে তা বাস্তব জীবনকে প্রতিফলিত করে এবং কাহিনিকে আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক ও বাস্তবোচিত করে তোলে।


২. চরিত্র : ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্কের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় সমাজসম্পর্ক। এই সম্পর্কজাত বাস্তব ঘটনাবলি নিয়েই উপন্যাসের কাহিনি নির্মিত হয়। আর, ব্যক্তির আচরণ, ভাবনা এবং ক্রিয়াকাণ্ডই হয়ে ওঠে উপন্যাসের প্রধান বর্ণনীয় বিষয়। উপন্যাসের এই ব্যক্তিই চরিত্র বা পযধৎধপঃবৎ। অনেকে মনে করেন, ঔপন্যাসে ঘটনাই মুখ্য, চরিত্র সৃষ্টি গৌণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ঘটনা ও চরিত্র পরস্পর নিরপেক্ষ নয়, একটি অন্যটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মহৎ ঔপন্যাসিক হিসেবে একজন লেখকের অন্বিষ্ট হয় দ্ব›দ্বময় মানুষ। ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ, সুনীতি-দুর্নীতি প্রভৃতির দ্ব›দ্বাত্মক বিন্যাসেই একজন মানুষ সমগ্রতা অর্জন করে এবং এ ধরনের মানুষই চরিত্র হিসেবে সার্থক বলে বিবেচিত হয়।


৩. সংলাপ : উপন্যাসের ঘটনা প্রাণ পায় চরিত্রগুরোর পারস্পরিক সংলাপে। যে কারণে ঔপন্যাসিক সচেষ্ট থাকেন স্থান-কাল অনুযায়ী চরিত্রের মুখে ভাষা দিতে। অনেক সময় বর্ণনার চেয়ে চরিত্রের নিজের মুখের একটি সংলাপ তার চরিত্র উপলব্ধির জন্য বহুল বিচার-বুদ্ধির প্রকাশ ঘটাতে পারেন। সংলাপ ও চরিত্রের বৈচিত্র্যময় মনস্তত্ত¡কে প্রকাশ করে এবং উপন্যাসের বাস্তবতাকে নিশ্চিত করে তোলে।


৪. পরিবেশ বর্ণনা : উপন্যাসের কাহিনিকে হতে হয় বাস্তবধর্মী ও বিশ্বাসযোগ্য। ঔপন্যাসিক উপনাসের দেশ-কালগত সত্যকে পরিস্ফ‚টিত করার অভিপ্রায়ে পরিবেশকে নির্মাণ করেন। পরিবেশ বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্রের জীবনযাত্রার ছবিও কাহিনিতে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই পরিবেশ মানে কেবল প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়; স্থান-কালের স্বাভাবিকতা, সামাজিকতা, ঔচিত্য ও ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক জীবন পরিবেশ। দেশ-কাল ও সমাজের রীতি-নীতি, আচার প্রথা ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠে উপন্যাসের প্রাণময় পরিবেশ।


৫. শৈলী বা স্টাইল : শৈলী বা স্টাইল হচ্ছে উপন্যাসের ভাষাগত অবয়ব সংস্থানের ভিত্তি। লেখকের জীবনদৃষ্টি ও জীবনসৃষ্টির সঙ্গে ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উপন্যাসের বর্ণনা, পরিচর্যা, পটভূমিকা উপস্থাপন ও চরিত্রের স্বরূপ নির্ণয়ে অনিবার্য ভাষাশৈলীর প্রয়োগই যেকোনো ঔপন্যাসিকের কাম্য। উপজীব্য বিষয় ও ভাষার সামঞ্জস্য রক্ষার মাধ্যমেই উপন্যাস হয়ে ওঠে সমগ্র, যথার্থ ও সার্থক আবেদনবাহী। উপন্যাসের লিখনশৈলী বা স্টাইল নিঃসন্দেহে যেকোনো লেখকের শক্তি, স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতার পরিচায়ক।


৬. লেখকের সামগ্রিক জীবন-দর্শন : মানবজীবনসংক্রান্ত যে সত্যের উদ্ঘাটন উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট হয় তাই লেখকের জীবনাদর্শন। আমরা একটি উপন্যাসের মধ্যে একই সঙ্গে জীবনের চিত্র ও জীবনের দর্শন-এই দুইকেই খুঁজি। এর ফলে সার্থক উপন্যাস পাঠ করলে পাঠক মানবজীবনসংক্রান্ত কোনো সত্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। উপন্যাসে জীবনদর্শনের অনিবার্যতা তাই স্বীকৃত।
উপন্যাসের উদ্ভব
গল্প শোনার আগ্রহ মানুষের সুপ্রাচীন।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষের এই আগ্রহের ফলেই কাহিনির উদ্ভব। তখন প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক হিসেবে মুখে মুখে প্রচলিত গল্প-কাহিনির বিষয় হয়ে ওঠে দেব-দেবী, পুরোহিত, গোষ্ঠীপতি ও রাজাদের কীর্তিকাণ্ড। লিপির উদ্ভবন, ব্যবহার ও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার হতে বহু শতক পেরিয়ে যায়। ততদিনে মানবসমাজে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট, পুরোহিত ও ভূস্বামীদের। ফলে দেবতা ও রাজ-রাজড়ার কাহিনিই লিপিবদ্ধ হতে থাকে ছন্দ ও অলংকারমণ্ডিত ভাষায়। এভাবেই ক্রমে কাব্য, মহাকাব্য ও নাটকের সৃষ্টি।


দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষায় তথা গদ্যে কাহিনি লেখার উদ্ভব ঘটে ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বে। মুখে মুখে রচিত কাহিনি যেমন রূপকথা, উপকথা, পুরাণ, জাতকের গল্প ইত্যাদি পরে গদ্যে লিপিবদ্ধ হলেও মানুষ এবং মানুষের জীবন ওইসব কাহিনির প্রধান বিষয় হতে পারেনি। কারণ তখনো সমাজে ব্যক্তি মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়নি, গড়ে ওঠেনি তার ব্যক্তিত্ব, ফলে কাহিনিতে ব্যক্তির প্রাধান্য লাভের উপায়ও ছিল অসম্ভব।


ইউরোপ যখন বাণিজ্য পুঁজির বিকাশ শুরু হয় তখন ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণার অবসান ঘটাতে থাকে। খ্রিষ্টীয় চৌদ্দো-ষোলো শতকেই ইউরোপীয় নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের ফলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভরতা, ইহজাগতিকতা এবং মানবতাবাদ। ক্রমে যা হয়ে ওঠে শিক্ষিত সমাজের সচেতন জীবনযাপনের অঙ্গ। রেনেসাঁসের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠিত হলে বিজ্ঞান ও দর্শনের অগ্রগতি বাধাহীন হয়ে ওঠে।

এরই ধারাবাহিকতায় বাণিজ্য পুঁজির বিকাশ আরম্ভ হলে সমাজে বণিক শ্রেণির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং রাজা, সামন্ত-ভূস্বামী এবং পুরোহিতদের সামাজিক গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভাগ্যনির্ভরতা পরিহার করে মানুষ হয়ে ওঠে স্বাবলম্বী, অধিকার-সচেতন এবং আত্ম প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ। এভাবে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র চর্চার পথ খুলে দেয়। সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিমানুষ এবং ব্যক্তির জীবনই হয়ে ওঠে সাহিত্যের প্রধান বিষয়। এভাবেই ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পরিবর্তনের পটভূমিকাতেই উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে উপন্যাসের।


অবশ্য এর পূর্ববর্তী কয়েক শতকেও পৃথিবীর নানা দেশে রচিত হয়েছে বিভিন্ন কাহিনিগ্রন্থ, যাতে ব্যক্তির জীবন, তার অভিজ্ঞতা, তার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, তার আশা-হতাশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গভীর বিশ্বস্ততার সঙ্গে। এর উলে­খযোগ্য উদাহরণ হলো- ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লানে’, ‘ডেকামেরন’, ‘ডন কুইকজোট’ ইত্যাদি।


উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে উনিশ শতক খুবই তাৎপর্যবহ। এ সময়ে লেখা হয়েছে পৃথিবীর বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। যেমন- ফ্রান্সের স্তাঁদালের ‘স্কারলেট অ্যান্ড ব্ল্যাক’, এমিল জোলার ‘দি জারমিনাল’; ব্রিটেনের হেনরি ফিল্ডিং-এর ‘টম জোন্স’, চার্লস ডিকেন্সের ‘এ টেল অফ টু সিটিজ’, রাশিয়ার লিও তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ফিয়োদর দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ ইত্যাদি। উপন্যাস-শিল্পকে বিকাশের শীর্ষ স্তর পৌঁছে দেয়া এসব মহৎ উপন্যাস পাঠকের মনকে যুক্ত করে বৃহত্তর জগৎ ও জীবনের সঙ্গে।


উপন্যাসের শ্রেণিবিভাগ


উপন্যাস বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। কখনও তা কাহিনি নির্ভর, কখনও চরিত্র-নির্ভর; কখনও মনস্তাত্তি¡ক, কখনও বক্তব্যধর্মী। বিষয় চরিত্র, প্রবণতা এবং গঠনগত সৌকর্যের ভিত্তিতে উপন্যাসকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে।

যেমন :
সামাজিক উপন্যাস : যে উপন্যাসে সামাজিক বিষয়, রীতি-নীতি, ব্যক্তি মানুষের দ্ব›দ্ব, আশা-আকাক্সক্ষার প্রাধান্য থাকে তাকে সামাজিক উপন্যাস বলা হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’, নজিবর রহমানের ‘আনোয়ারা’, কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুল­াহ’, সৈয়দ ওয়ালীউল­াহ্র ‘লালসালু’ প্রভৃতি সামাজিক উপন্যাসের উদাহরণ।


ঐতিহাসিক উপন্যাস : জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্রের আশ্রয়ে যখন কোনো উপন্যাস রচিত হয় তখন তাকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে লেখক নতুন নতুন ঘটনা বা চরিত্র সৃজন করে কাহিনিতে গতিমত্তা ও প্রাণসঞ্চার করতে পারেন কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুতি হতে পারেন না। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধর্মপাল’ মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’, সত্যেন সেনের ‘অভিশপ্ত নগরী’, ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে বিবেচিত। রুশ ভাষায় লিখিত তলস্তয়ের কালজয়ী গ্রন্থ ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ভাসিলি ইয়ানের ‘চেঙ্গিস খান’ বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস।


মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাস : মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসের প্রধান আশ্রয় পাত্র-পাত্রীর মনোজগতের ঘাত-সংঘাত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। চরিত্রের অন্তর্জগতের জটিল রহস্য উদ্ঘাটনই ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য। আবার সামাজিক উপন্যাস ও মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসে নৈকট্যও লক্ষ করা যায়। সামাজিক উপন্যাসে যেমন মনস্তাত্তি¡ক ঘাত-প্রতিঘাত থাকতে পারে, তেমনি মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসেও সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাত থাকতে পারে। মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসে কাহিনি অবলম্বন মাত্র, প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে মানবমনের জটিল দিকগুলো সার্থক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা। বিশ্বসাহিত্যে ফরাসি লেখক গুস্তাভ ফ্লবেয়ার লিখিত ‘মাদাম বোভারি’, রুশ লেখক দস্তয়ভস্কি লিখিত ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এবং বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’, সৈয়দ ওয়ালীউল­াহ্-র ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসের উজ্জ্বল উদাহরণ।


রাজনৈতিক উদাহরণ : সমাজ-বিকাশের অন্যতম চালিকাশক্তি যে রাজনীতি সেই রাজনৈতিক ঘটনাবলি, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট চরিত্রের কর্মকাণ্ড যে উপন্যাসে প্রাধান্য লাভ করে তাকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলে। এ ধরনের উপন্যাসে রাজনৈতিক ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আন্দোলন-সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্সক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপুল পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক উপন্যাসের দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, গোপাল হালদারের ‘ত্রয়ী’ উপন্যাস-‘একদা’, ‘অন্যদিন’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝড় ও ঝরাপাতা’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ ও ‘ঢোড়াই চরিত মানস’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিহ্ন’, শহীদুল­াহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ প্রভৃতি।


আঞ্চলিক উপন্যাস : অঞ্চল বিশেষের মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং স্থানিক রং ও স্থানিক পরিবেশবিধৌত জীবনাচরণ নিয়ে যে উপন্যাস লেখা হয় তাকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, অদ্বৈত মল­বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাঁশবনের কন্যা’ ও ‘সমুদ্রবাসর’ প্রভৃতির নাম এক্ষেত্রে স্মরণীয়।
রহস্যোপন্যাস : রহস্যোপন্যাসে ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য রহস্যময়তা সৃষ্টি এবং উপন্যাসের উপান্ত পর্যন্ত তা ধরে রাখা।

এ জাতীয় উপন্যাসে রহস্য উদঘাটনের জন্য পাঠক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকে। দীনেন্দ্রকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, নীহারঞ্জন গুপ্ত, কাজী আনোয়ার হোসেন প্রমুখ লেখক বাংলা ভাষায় বহু রহস্যোপন্যাস লিখেছেন। ফেলুদা সিরিজ, কিরীটা অমনিবাস, মাসুদ রানা সিরিজ, কুয়াশা সিরিজ প্রভৃতি এ জাতীয় উপন্যাসের দৃষ্টান্ত।


চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস : মানুষের মনোলোকে বর্তমানের অভিজ্ঞতা, অতীতের স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের কল্পনা এক সঙ্গে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহের ভাষিক বর্ণনা দিয়ে চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস লিখিত হয়। আইরিশ লেখক জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ এমনই একটি বিখ্যাত উপন্যাস। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’, সৈয়দ ওয়ালীউল­াহ্র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ চৈতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস হিসেবে পরিচিত।


আত্মজৈবনিক উপন্যাস : ঔপন্যাসিক তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে যখন আন্তরিক শিল্পকুশলতায় উপন্যাসে রূপদান করেন তখন তাকে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলে। এ ধরনের উপন্যাসে লেখকের ঔপন্যাসিক কল্পনার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাঁর ব্যক্তি জীবনের নানা অন্তর্ময় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ঘটনাসূত্র। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’, বিভূতিভূবণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’-‘অপরাজিত’ এ ধরনের উপন্যাসের দৃষ্টান্ত।


রূপক উপন্যাস : সাহিত্যের রূপকাশ্রয় কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। তবে কখনো কখনো ঔপন্যাসিক তাঁর রচনায় উপস্থাপিত কাহিনি কাঠামোর অন্তরালে কোনো বিশেষ ব্যতিক্রমধর্মী রূপকাশ্রয়ী বক্তব্যের সাহায্যে উপন্যাসের শিল্পরূপ প্রদান করেন। এ ধরনের উপন্যাসকে রূপক উপন্যাস বলা হয়। প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের রূপক উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’- যেখানে পাত্র-পাত্রী মানুষ নয় জন্তু-জানোয়ার। রূপক উপন্যাস সৃষ্টিতে শওকত ওসমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘সমাগম’, ‘রাজা উপাখ্যান’, ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’ রূপক উপন্যাসের সার্থক দৃষ্টান্ত।
বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশ


বাংলার ভাষায় উপন্যাস লেখার সূচনা ঘটে উনিশ শতকে। টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হয় প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামের কাহিনিগ্রন্থ। আধুনিক উপন্যাসের বেশ কিছু লক্ষণ, যেমন- জীবনযাপনের বাস্তবতা, ব্যক্তিচরিত্রের বিকাশ এবং মানবিক কাহিনি ইত্যাদি এ উপন্যাসে ফুটে ওঠে এবং একই সঙ্গে কিছু সীমাবদ্ধতাও সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে উলে­খ্য যে, উনিশ শতকের প্রথম ষাট বছরে এ দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তথা উপন্যাস পাঠের উপযোগী জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি একজন সার্থক ঔপন্যাসিকের আগমনকে ক্রমশ অনিবার্য করে তোলে।

বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস লেখেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫)। কাহিনি বিন্যাস এবং চরিত্র চিত্রসহ উপন্যাস রচনায় শৈল্পিক কৌশল সম্পর্কে সচেতন হয়ে তিনিই প্রথম জীবনের গভীর দর্শন-পরিস্রুত ব্যক্তি-মানুষের কাহিনি উপস্থাপন করেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসেই অতীতচারী কল্পনার প্রাধান্য এবং সমকালীন জীবনের স্বল্প উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কেবল ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাস দুটিতে সমকালীন জীবন ও বাস্তবতা মোটামুটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের জটিল সমস্যা ও তীব্র সংকটের কাহিনি তিনি ওই দুই উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্তে¡ও বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা উপন্যাসের বিকাশের পথ উন্মোচন করেছেন।


বঙ্কিম-পরবর্তী বাংলা উপন্যাসের ধারায় প্রধান শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আধুনিক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি সামাজিক, পারিবারিক, মনস্তাত্তি¡ক ও ব্যক্তিজীবনের সংকটমুখ্য কাহিনি রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর উলে­খযোগ্য উপন্যাস ‘চোখের বালি’, ‘গোরা’, ‘যোগাযোগ’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘শেষের কবিতা’। তিনিই প্রথম রূপায়ন করেন প্রকৃত নাগরিক জীবন। উদার মানবতাবাদী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ধর্ম, আদর্শ ও সংস্কার নয়- মানব জীবন অনেক বেশি মূল্যবান- এই বিবেচনা তাঁর প্রায় সকল উপন্যাসেই উপস্থিত। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে তাঁর ‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়’ প্রভৃতি উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাসে ব্যক্তিজীবনের আশা-আকাক্সক্ষার পাশাপাশি বৃহত্তর জীবনের যাবতীয় প্রসঙ্গই প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।


বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষে বাংলা উপন্যাস তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, আর জনপ্রিয়তম ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাসের বিষয় বাঙালি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত হিন্দু সমাজের গ্রামীণ ও গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনি। তাঁর
অন্তরঙ্গ ভাষা এবং অনবদ্য বর্ণনা-কৌশল বাংলা সাহিত্যে বিরল। সামাজিক সংস্কারের পীড়নে নারীর অসহায়তার করুণ চিত্র অঙ্কনে তিনি অদ্বিতীয়। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সামাজিক বাস্তবতার পাশাপাশি মুক্তি-আকাক্সক্ষার ইচ্ছাসঞ্জাত মানব মনের জটিলতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘গৃহদাহ’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’ প্রভৃতি উপন্যাসে।


রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সময়ে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বাস্তবতা দ্রুত বদলে যায়। মানুষের পারিবারিক জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে শিক্ষার প্রসার ও অর্থনেতিক সংকট। একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব এবং অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা সাধারণ মানুষকে যেমন করে তোলে অস্থির তেমনি তাকে করে তোলে অধিকার-সচেতন। এই নতুন সামাজিক বাস্তবতায় নতুন দিগন্ত সন্ধানের তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে যুক্ত হন নতুন ধারার কয়েকজন লেখক। এঁরা মানুষের মনোলোকের জটিল রহস্য সন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের কাছে সাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে সমাজের দরিদ্র এবং অবজ্ঞাত মানুষের জীবন।

এঁরা হলেন : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই তিন লেখক রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রধান ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচিত হন। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-‘অপরাজিত’, তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’-‘পঞ্চগ্রাম’, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।


এক ঐতিহাসিক পটভূমিতেই বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হক, নজিবর রহমান প্রমুখ লেখকের আবির্ভাব ঘটে। বিশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে আবির্ভূত হন কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ন কবীর প্রমুখ। ১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলা নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশে পরিণত হয়। নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এখানে সাহিত্য সাধনা নতুন মাত্রা লাভ করে। সূচনায় বাংলাদেশের উপন্যাস, আধুনিক চিন্তা ও ভাবধারার অনুসারী সৈয়দ ওয়ালীউল­াহ্, শওকত ওসমান, আবু রুশদ্ প্রমুখ লেখকের হাত ধরে এগিয়ে চলে।

উপন্যাসে উপস্থাপিত হয় ব্যক্তি, সমাজ ও সমগ্র জীবনের বিশ্লেষণমূলক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলটি ছিল পাকিস্তানের এক ধরনের উপনিবেশ। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে নাগরিক জীবন বিকশিত হলেও গ্রামীণ জীবন ছিল পশ্চাৎপদ। অন্ধ কুসংস্কার, ধনী-দরিদ্র্যের দ্ব›দ্ব, দারিদ্র্যসহ নানা সমস্যায় বিপন্ন ও বিপর্যস্ত ছিল মানুষের জীবন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও বাংলাদেশের উজ্জ্বল অভ্যুদয়ের মাধ্যমে বাঙালির জাতয়ি জীবনে সৃষ্টি হয় নতুন উদ্দীপনা। নাগরিক জীবনে যেমন লাগে আধুনিকতার ছোঁয়া তেমনি শেকড়-সন্ধানী গ্রামীণ জীবনেও সৃষ্টি হয় নবতর উদ্দীপনা। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকগণ রচনা করেন নানা ধরনের উপন্যাস। নিচে উলে­খযোগ্য কয়েকটি উপন্যাসের নাম দেয়া হলো :


আবুল ফজলের ‘রাঙা প্রভাত’, সত্যেন সেনের ‘অভিশপ্ত নগরী’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, শওকত ওসমানের ‘জননী’, ‘ক্রীতদাসের হাসি’, সৈয়দ ওয়ালীউল­াহ্র ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, শহীদুল­াহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ ও ‘সারেং বউ’, সরকার জয়েনউদ্দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’, রশীদ করিমের ‘উত্তম পুরুষ’, জহির রায়হানের ‘হাজার বছরে ধরে’, আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, আবু ইসহাকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’,

আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’, ও ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ও ‘খোয়াবনামা’, সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’, ও ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, হুমায়ন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’, ও ‘জ্যোস্না ও জননীর গল্প’ এবং শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ ইত্যাদি।
‘লালসালু’র প্রকাশতথ্য


‘লালসালু’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকা-র কমরেড পাবলিশার্স এটি প্রকাশ করে। প্রকাশক মুহাম্মদ আতাউল­াহ। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার কথাবিতান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির দশম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। নওরোজ কিতাবিস্তান ‘লালসালু’ উপন্যাসের দশম মুদ্রণ প্রকাশ করে।


১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ‘লালসালু’ উপন্যাসের উর্দু অনুবাদ করাচি থেকে প্রকাশিত হয় ‘খধষ ঝযধষঁ’ নামে। অনুবাদক ছিলেন কলিমুল­াহ।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’র ফরাসি অনুবাদ। খ’ধৎনৎব ংধহং ৎধপরহং নামে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি অনুবাদ করেন সৈয়দ ওয়ালীউল­াহ্-র সহধর্মিণী অ্যান-ম্যারি-থিবো। প্যারিস থেকে এ অনুবাদটি প্রকাশ করে ঊফরঃরড়হ’ং ফঁ ঝবঁরষ প্রকাশনী। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এ অনুবাদটির পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।


১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। ‘ঞৎবব রিঃযড়ঁঃ জড়ড়ঃং’ নামে লন্ডনের ঈযধঃঃড় ধহফ রিহফঁং খঃফ. এটি প্রকাশ করেন। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল­াহ্ নিজেই এই ইংরেজি অনুবাদ করেন।
পরবর্তীকালে ‘লালসালু’ উপন্যাসটি জার্মান ও চেক ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

উপন্যাসের সংজ্ঞা , গঠন ও প্রকারভেদের বিস্তারিত